প্রায় তিন শ বছর আগের কথা চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার বারখাইন ইউনিয়নের শোলকাটা গ্রামে স্ত্রীকে ভালোবেসে মসজিদ নির্মাণ করেছেন মুঘল শাসন আমলের রাজা শেখ আমির মুহাম্মদ চৌধুরী জমিদার। অমর প্রেমের কীর্তি আগ্রার তাজমহল। স্ত্রী মমতাজের প্রতি ভালবাসার স্বীকৃতিস্বরূপ স¤্রাট শাহজাহান গড়েছেন তাজমহল। টেকনাফের জমিদারকন্যা মাথিন আর পুলিশ অফিসার ধীরাজের প্রেমগাঁথা আছে ‘মাথিনের কূপে’। আমাদের চারপাশে এরকম কতশত প্রেমের নিদর্শন। তবে স্ত্রীকে ভালোবেসে মসজিদ নির্মাণ কিছুটা হলেও ব্যতিক্রম।
ইতিহাস গবেষক জামাল উদ্দিনের ‘দেয়াঙ পরগনার ইতিহাস’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, আরাকান রাজসভার মহাকবি আলাওলের দ্বিতীয় কন্যা ছুরুত বিবির বিয়ে হয় দেয়াঙ পরগনার মুঘল অংশের দেওয়ান পরিবারের এক জমিদার বাড়ির ছেলে শেখ আমির মুহাম্মদ চৌধুরী জমিদারের সাথে। বিয়ের পর শেখ আমির মুহাম্মদ চৌধুরী স্ত্রীর নামেই এ ছুরুত বিবি মসজিদ নির্মাণ করেন।
ধারণা করা হচ্ছে, মুঘল শাসনামলে (১৭১৩-১৭১৮) এ মসজিদ নির্মিত হয়। প্রাচীনতম এ মসজিদটি ঘিরে স্থানীয়দের মনে রয়েছে নানা কথা। এক সময় এ মসজিদে নামাজ পড়তে আসতেন না কোনো মানুষ। তাদের ধারণা ছিল জিনেরা এ মসজিদে নামাজ পড়তেন, তাই ভয়ে কেউ নামাজ পড়তেন না। ১৯৬০ সালে সর্ব প্রথম এ মসজিদে নামাজ পড়েন আনোয়ারা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ধর্মীয় শিক্ষক মৌলানা ইদ্রিছ আহমদ।
অনেকের মতে, এ মসজিদে মানত করলে পূরণ হয় মনের আশা। তাই শুক্রবারসহ প্রতিদিনই দূর-দূরান্ত থেকে মসজিদটিতে ছুটে আসেন বিভিন্ন ধর্মের মানুষ। প্রতি শুক্রবার ১ থেকে ২ হাজার মানুষের সমাবেশ ঘটে এই মসজিদে। একসাথে জুমার নামাজ আদায় করেন। মসজিদে আসা অনেকেই তাদের ইচ্ছা পূরণের মানত করেন। কথিত আছে এখানে যে ইচ্ছা করা যায়, তাই পূরণ হয়। এমন বিশ^াস নিয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে মানত বা ইচ্ছা পূরণের আশায় বিভিন্ন ধর্মের শত শত নারী-পুরুষ এখানে এসে মসজিদে নামাজ আদায় ও মাজার জিয়ারত করেন।
মসজিদটির স্থাপত্য শৈলীতে রয়েছে মধ্যযুগের মুসলিম শিল্পধারা। ৩টি ছোট বড় গম্বুজ আর ৩০ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট একটি মিনার। মসজিদের খিলান, আর সু-উচ্চ মিনার বাড়িয়ে দিয়েছে নান্দনিকতা। মসজিদের দক্ষিণ ও পশ্চিমে রয়েছে বিশাল দুটি দিঘি। দক্ষিণের দিঘিটি ছুরুত বিবি দিঘি আর পশ্চিমের দীঘিটি আমির খাঁ দিঘি নামে পরিচিত। মসজিদের দক্ষিণ পাশে সারি সারি করে রয়েছে ১২টি কবর। কবরগুলো ছুরুত বিবির পরিবারের সদস্যদের, যাদের হত্যা করেছিলেন মনু মিয়া।
ইতিহাস গ্রন্থে জানা যায়, ১৫৭৫ সালে দুর্ভিক্ষ ও মহামারিতে গৌড় রাজ্য ধ্বংস স্তপে পরিণত হলে গৌড় রাজ্যের সেনাপতি শেখ মোহাম্মদ আদম গৌড়ী গৌড়রাজ্য ত্যাগ করে দেয়াঙ রাজ্যের অন্তর্গত শোলকাটা গ্রামে স্বপরিবারে বসতি স্থাপন করেন। এ বংশের একজন জমিদার ছিলেন শেখ আমির মোহাম্মদ চৌধুরী। ১০৫১ মুঘল আমলের এক ‘একরারনামা’ মূলে মুঘল শাসন আমলের রাজা শেখ আমির মুহাম্মদ চৌধুরীর উপর জমিদারির ভার ছিল।
জানা যায়, ছুৃরুত বিবির বিয়ের বছর দেড়েক পর তার ঘর আলো করে আসে দুই সন্তান জাফর খাঁ আর মুজাফফর খাঁ। ছেলেরা একটু বড় হতেই মুঘল স¤্রাট তাদের ডেকে নেন দিল্লীতে। হাজার লোক দিল্লীর রাজপথে দাঁড়িয়ে সম্মান জানিয়ে তাদের নিয়ে যায় রাজপ্রাসাদে। সেখানে মুঘলদের পক্ষ থেকে দুজনকে নবাবী সনদ দেওয়া হয়। ইতিহাস থেকে আরও জানা যায়, আনোয়ারার আরেকজন প্রভাবশালী জমিদার ছিলেন জবরদস্ত খাঁ ওরফে মনু মিয়া। ছুরুত বিবির দুই সন্তানের নবাবী সনদ পাওয়া মেনে নিতে পারেননি তিনি। ফলে তাদের জমিদারি পরিচালনায় প্রকাশ্যে ও গোপনে নানাভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে থাকেন মনু মিয়া।
অন্যদিকে, নবীন দুই জমিদারের পক্ষে মনু মিয়ার এসব অন্যায় অপকর্মের প্রতিবাদ করার মতো সাধ্য ছিল না। কারণ- সে সময় মনু মিয়ার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন চট্টগ্রামের প্রভাবশালী আরেক জমিদার নবাব ইয়াছিন খান। কথিত আছে, ইয়াছিন খানের সহযোগিতায় ছুরুত বিবির দুই সন্তান জাফর খাঁ ও মোজাফফর খাঁ’কে ধরে নিয়ে যান মনু মিয়া। এরপর তারা আর কখনো ফিরে আসেননি। ঘটনার বেশ কিছুদিন পর চট্টগ্রাম নগরীর কাটা পাহাড় থেকে দুই ভাইয়ের খ-িত মস্তক উদ্ধার করা হয়।
পরবর্তী সময়ে এ নির্মম হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে আক্রোশে ফেটে পড়ে দেওয়ান পরিবার। ফলে পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে দেওয়ান পরিবারের আরো ১৬ সদস্যকে তরবারি দিয়ে কেটে টুকরো টুকরো করে হত্যা করেন মনু মিয়া। সেই ষোল হত্যাকান্ড থেকেই শোলকাটা গ্রামের নামের উৎপত্তি।
বংশ পরম্পরায় মসজিদটির পঞ্চম মোতাওয়াল্লী স্থানীয় বাসিন্দা আবুল কাশেম বলেন, এক সময় এ মসজিদে শুধু জোহর আর আসরের নামাজই পড়তেন মানুষ। জিনেরা এখানে নামাজ পড়তো বলে জনশ্রুতি ছিল, ফলে সন্ধ্যা হলে ভয়ে আসতেন না কেউ। ১৯৯০ সালের পর থেকে এখানে নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করছেন মানুষ।
তিনি আরও বলেন, আমার পূর্ব পুরুষেরা ধারাবাহিক ভাবে বংশে একজন করে এ মসজিদের মোতাওয়াল্লির দায়িত্ব পালন করে আসছে। দলিল পত্রাদি সূত্রে বংশ পরম্পরায় আমি ৫ম মোতাওয়াল্লি। ১৯৮৮ সালে আমার বাবা নুরুল আলম মারা যাওয়ার পর আমি এ দায়িত্ব পায়।