আজ বিশ্ব শারীরিক কার্যকলাপ দিবস। শারীরিক কার্যকলাপ স্বাস্থ্যকর জীবনধারা এবং সুস্থতা নিশ্চিত করতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ২০০২ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ৬ এপ্রিলকে এই দিবস হিসেবে ঘোষণা করে, যার উদ্দেশ্য শারীরিক কার্যকলাপের গুরুত্ব তুলে ধরা এবং মানুষকে সক্রিয় জীবনযাপনে উৎসাহিত করা। বিশেষ করে বাংলাদেশে, যেখানে শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা স্বাস্থ্য ও সামাজিক চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করছে, এই দিবসটি আরও গুরুত্বপূর্ণ।
শারীরিক কার্যকলাপ: গুরুত্ব ও উপকারিতা
শারীরিক কার্যকলাপ বলতে যেকোনো শারীরিক নড়াচড়া বুঝায় যা শক্তি ব্যয় করে, যেমন হাঁটা, সাইকেল চালানো, গৃহস্থালির কাজ বা খেলাধুলা। শারীরিক কার্যকলাপের মধ্যে নিম্ন-তীব্রতা কার্যকলাপ (যেমন হাঁটা বা গৃহস্থালির কাজ), মাঝারি-তীব্রতা কার্যকলাপ (যেমন দ্রুত হাঁটা বা সাইকেল চালানো), এবং উচ্চ-তীব্রতা কার্যকলাপ (যেমন জগিং বা ফুটবল খেলা) অন্তর্ভুক্ত। এটি হৃদরোগ, স্ট্রোক, ডায়াবেটিস, ক্যান্সারসহ নানা রোগ প্রতিরোধে সহায়ক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায়। WHO অনুযায়ী, প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য সপ্তাহে ১৫০ মিনিট মাঝারি তীব্রতা বা ৭৫ মিনিট উচ্চ তীব্রতা কার্যকলাপ প্রয়োজন। শিশুদের জন্য প্রতিদিন এক ঘণ্টা শারীরিক কার্যকলাপ অপরিহার্য। শারীরিক কার্যকলাপ পরিবেশেরও উন্নতি ঘটাতে পারে, যেমন জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানো এবং পরিষ্কার বায়ু সৃষ্টি করা। তবে, বিশ্বব্যাপী শারীরিক কার্যকলাপের স্তর অপর্যাপ্ত, এবং শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা একটি প্রধান জনস্বাস্থ্য সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশে শারীরিক কার্যকলাপ: বর্তমান চ্যালেঞ্জ ও প্রতিবন্ধকতা
বাংলাদেশ, অন্যান্য গ্লোবাল সাউথের দেশের মতো, তার জনগণের মধ্যে শারীরিক কার্যকলাপ প্রসারের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে। ২০২২ সালের জাতীয় STEPS জরিপ ফর নন-কমিউনিকেবল ডিজিজ রিস্ক ফ্যাক্টরস অনুসারে, বাংলাদেশী প্রাপ্তবয়স্কদের ১৯.৫% পর্যাপ্ত পরিমাণে সক্রিয় নন, যেখানে মহিলারা পুরুষদের তুলনায় কম সক্রিয় (যথাক্রমে ১৪.৬% এবং ২৩.৯%) । WHO-এর ২০২২ সালের শারীরিক কার্যকলাপ প্রোফাইল আরও উদ্বেগজনক বৈষম্য তুলে ধরে, যেখানে ১৬% পুরুষ এবং ৪০% মহিলা প্রাপ্তবয়স্ক যথেষ্ট পরিমাণে সক্রিয় নন।
বাংলাদেশী কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে পরিস্থিতি আরও উদ্বেগজনক। ২০১৪ সালের গ্লোবাল স্কুল-ভিত্তিক ছাত্র স্বাস্থ্য জরিপ (GSHS) অনুযায়ী, ৫৮.৬% কিশোর-কিশোরী পর্যাপ্ত পরিমাণে সক্রিয় ছিল না। WHO-এর ২০২২ সালের প্রোফাইল থেকে আরও বেশি মাত্রার নিষ্ক্রিয়তার ইঙ্গিত পাওয়া যায়, যেখানে ৬৩% ছেলে এবং ৬৯% মেয়ে সুপারিশকৃত কার্যকলাপের মাত্রা পূরণ করতে পারেনি। এছাড়াও, সাম্প্রতিক জনসংখ্যাভিত্তিক জরিপে দেখা গেছে যে ৫০.৩% কিশোরী মেয়ে এবং ২৯% কিশোর ছেলে পর্যাপ্ত পরিমাণে সক্রিয় নন।
এই অবস্থা শহুরে পরিবেশ, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বাধা, অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা এবং পরিবেশগত সমস্যা দ্বারা আরও জটিল হচ্ছে। নগরায়নের কারণে খেলার মাঠ ও পার্কের অভাব, যানজট, স্ক্রিন টাইমের বৃদ্ধি এবং সক্রিয় জীবনযাত্রার অভাব শারীরিক কার্যকলাপে বাধা সৃষ্টি করছে। মহিলাদের জন্য শারীরিক কার্যকলাপের সুযোগ সীমিত এবং নিরাপত্তা ইস্যুগুলিও সমস্যা সৃষ্টি করছে। তদুপরি, শারীরিক কার্যকলাপের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতার অভাব এবং অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতার কারণে শহর ও গ্রামীণ এলাকায় শারীরিক কার্যকলাপের সুযোগ সীমিত রয়েছে।
বাংলাদেশে শারীরিক কার্যকলাপ উন্নয়নে আমাদের করণীয়: সামাজিক প্ল্যাটফর্মের ভূমিকা
বাংলাদেশে শারীরিক কার্যকলাপের উন্নতি সাধনে সামাজিক প্ল্যাটফর্ম এবং প্রযুক্তির ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এটি সাধারণ জনগণের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে এবং সক্রিয় জীবনযাত্রার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করতে সাহায্য করবে। সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোতে শারীরিক কার্যকলাপের উপকারিতা নিয়ে প্রচার এবং অনুপ্রেরণামূলক ভিডিও শেয়ার করা যেতে পারে, যা জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করবে। ফিটনেস চ্যালেঞ্জ বা অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমে শারীরিক কার্যকলাপে অংশগ্রহণ বাড়ানো সম্ভব। ক্রীড়াবিদ এবং সফল ব্যক্তিরা শারীরিক কার্যকলাপের গুরুত্ব শেয়ার করে মানুষকে অনুপ্রাণিত করতে পারেন। মোবাইল অ্যাপস ও স্মার্ট ডিভাইসের মাধ্যমে শারীরিক কার্যকলাপ ট্র্যাক করা সহজ হবে এবং অংশগ্রহণকারীদের উৎসাহিত করবে। সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ভার্চুয়াল ফিটনেস গ্রুপ বা প্রোগ্রাম আয়োজন করা যেতে পারে, যা কমিউনিটি-ভিত্তিক অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করবে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও এনজিওর মাধ্যমে সোশ্যাল মিডিয়ায় শারীরিক কার্যকলাপ প্রচারণা চালানো এবং সরকারের বিভিন্ন স্বাস্থ্য কর্মসূচী বা এনজিওর প্রচারণা চালানো শারীরিক কার্যকলাপের প্রচারে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
বিশ্ব শারীরিক কার্যকলাপ দিবস: আমাদের প্রতিশ্রুতি
আজকের বিশ্বে শারীরিক কার্যকলাপের গুরুত্ব বাড়লেও, বাংলাদেশে অপরিকল্পিত নগরায়ন, ক্রীড়া সুবিধার অভাব, লিঙ্গ বৈষম্য এবং সচেতনতার অভাব এখনও চ্যালেঞ্জ। এসব প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে শারীরিক কার্যকলাপের সুযোগ তৈরি করতে পারলে, আমরা একটি সুস্থ, শক্তিশালী, এবং আনন্দময় জাতি গড়ে তুলতে পারব।
আমরা সবাই যদি সক্রিয় থাকি, তাহলে দেশজুড়ে এক নতুন পরিবর্তন আসবে।
বিশ্ব শারীরিক কার্যকলাপ দিবসে, আসুন আমরা একত্রিত হই এবং শারীরিক কার্যকলাপকে আমাদের জীবনের একটি অপরিহার্য অংশ হিসেবে গ্রহণ করার প্রতিশ্রুতি নেই। শিক্ষক, সামাজিক নেতৃবৃন্দ, নীতিনির্ধারক এবং সাধারণ মানুষ—সবাই মিলে যদি একসঙ্গে কাজ করি, তাহলে আমরা শারীরিক কার্যকলাপের মাধ্যমে সকলের জন্য একটি সুস্থ ও সক্রিয় ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে পারব।
এই বিশ্ব শারীরিক কার্যকলাপ দিবসে, আসুন আমরা অঙ্গীকার করি:
• আমরা আরও বেশি চলাফেরা করব।
• আমরা কম বসে থাকব।
• আমরা সক্রিয় থাকার আনন্দ উপভোগ করব।
এটাই আমাদের লক্ষ্য! এই প্রতিশ্রুতি নিয়ে, আমরা একে অপরকে প্রেরণা দিব এবং বাংলাদেশকে একটি স্বাস্থ্যকর, সুখী, এবং সক্রিয় জাতি হিসেবে গড়ে তুলব।
সক্ৰিয় জীবনধারা হোক আমাদের অঙ্গীকার!
লেখক: ড. আসাদুজ্জামান খান, সহযোগী অধ্যাপক, স্কুল অফ হেলথ অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন সায়েন্সেস, কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়, অস্ট্রেলিয়া এবং সভাপতি, অ্যাকটিভ হেলদি কিডস, বাংলাদেশ
এবং
ড. কাজী রুমানা আহমেদ, অ্যাডজাঙ্কট রিসার্চার, স্কুল অফ হেলথ অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন সায়েন্সেস, কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়, অস্ট্রেলিয়া এবং সদস্য সচিব, অ্যাকটিভ হেলদি কিডস, বাংলাদেশ