“সিস্টেমের ভুলে বলি হলো সন্তান। এমন এক দেশে বাস করি, যেখানে ভুলটাই নিয়ম!”
মাহতাবের বাবার কণ্ঠে এই বাক্যটা যেন শুধু ব্যক্তিগত শোক নয়—একটি রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে নিঃশব্দ অভিশাপ।
২১ জুলাই ২০২৫—প্রশিক্ষণরত অবস্থায় একটি যুদ্ধবিমান মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ওপর ভূপাতিত হয়। শ্রেণিকক্ষে বসে থাকা শিক্ষার্থীদের মাথার ওপর আকাশ ভেঙে পড়ে। ৩১ জন নিষ্পাপ ক্ষুদ্র শিক্ষার্থী, ২ জন শিক্ষক এবং পাইলটসহ মোট ৩৩ জন প্রাণ হারায়। যার মধ্যে মাইলস্টোন স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র মাহতাব, যার অবস্থান ছিল শ্রেণিকক্ষে, পৌঁছে গেল মৃত্যুর দুয়ারে। আশঙ্কাজনক অবস্থায় চিকিৎসাধীন বহু শিশু শিক্ষার্থী—তাদের অপরাধ একটাই: তারা কেবল ‘নিরাপদ শিক্ষা’র অধিকার চেয়েছিল।
রাষ্ট্র বলবে “এ দুর্ঘটনা”, কিন্তু জাতি জানে—এটি কোনো বিচ্ছিন্ন দুর্ঘটনা নয়; বরং এটি রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থা, অবহেলা ও অদক্ষতার পূর্বাভাসিত ফলাফল।
আমরা একদিন স্বাধীনতা চেয়েছিলাম একটি ফ্যাসিস্টমুক্ত, দুর্নীতিমুক্ত, মানবিক রাষ্ট্রের স্বপ্নে নিজ জীবন বিসর্জন দিতে রাজপথে নেমেছিলাম। জুলাই বিপ্লবের আগুনে যারা নিজেদের পুড়িয়ে দিয়েছিল- তারা এবং আমরা বিশ্বাস করেছিলাম—এই রাষ্ট্র একদিন তার ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নিরাপত্তা দিতে পারবে। কিন্তু বাস্তবতা বলছে আমরা এখনো সেই একই ব্যর্থ, দায়িত্বহীন রাষ্ট্রে বাস করছি যেখানে ভুলই নিয়ম, আর জবাবদিহির জায়গায় বসে আছে অজুহাত। হাসপাতাল থেকে শুরু করে সড়ক, প্রশাসন থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান—যেদিকে তাকাই, দেখি বিভ্রান্তি, ভোগান্তি আর ভুলের অন্ধকার চক্র। আমরা এমন দেশ চাইনি। আমরা চাইনি এমন এক দ্বিতীয় ‘স্বাধীনতা’ যেখানে শিশুরা শ্রেণিকক্ষে বই খুলে বসে থেকেও কফিনে করে ঘরে ফেরে।
আজ যদি শ্রেণিকক্ষে অধ্যয়নরত শিশুদের নিঃসহায় মৃত্যু আমাদের জাগিয়ে না তোলে, প্রশ্ন না তুলতে শেখায়, প্রতিরোধে না দাঁড় করায়, তাহলে কালও নতুন নতুন মাহতাব, নিধিরা হারিয়ে যাবে ইতিহাসের ভুল পাতায়। কিন্তু বরাবরের মতন এবারও আমরা চুপচাপ তাকিয়ে থাকবো, সংবাদের শিরোনাম পড়ব, তারপর ভুলে যাবো। কারন ভুলে যাওয়াটাই আমাদের সবচেয়ে বড় অভ্যাস, নীরবতাই আমাদের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি সন্তানের লাশের খবরকে মেনে নিতে। আর এই অভ্যস্ততার নামই আজকের সবচেয়ে বড় জাতিগত সংকট।
ড: ফারজানা ইসলাম রুপা
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ
বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএমইউ)
মিরপুর ডিওএইচএস, ঢাকা।